"ভোটারবন্দি" নাকি তালিকা "শুদ্ধিকরণ"? SIR নিয়ে উত্তাল বঙ্গ রাজনীতি, বিষয়টি পৌঁছাল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত
নিজস্ব প্রতিবেদন, লোকসংবাদ
কলকাতা: ১৫ নভেম্বর, ২০২৫
পশ্চিমবঙ্গে আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিশন (Special Intensive Revision - SIR) বা ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই রাজ্য রাজনীতিতে বিতর্ক তুঙ্গে। শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস (TMC) এবং বিরোধী দল বিজেপি (BJP) একে অপরের বিরুদ্ধে ভোটার তালিকা কারচুপির (Voter Manipulation) অভিযোগ তুলে কার্যত সম্মুখ সমরে। এই প্রক্রিয়া এখন শুধু রাজনৈতিক মাঠেই সীমাবদ্ধ নেই, এর আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মামলা পৌঁছেছে সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court) পর্যন্ত।
তৃণমূলের তোপ: "এটা ভোটারবন্দি, বিজেপির ষড়যন্ত্র"
রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস শুরু থেকেই এই নিবিড় সংশোধনের (SIR) তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে এই প্রক্রিয়াকে 'ভোটারবন্দি' (Votebandi) আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নির্বাচনের আগে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই 'তাড়াহুড়ো করে' সংশোধনের কাজ শুরু করেছে।
মূল অভিযোগ: তৃণমূলের দাবি, ২০০২ সালের পুরনো ভোটার তালিকাকে ভিত্তি হিসেবে নিয়ে এই সংশোধনের কাজ শুরু করা হয়েছে। এতে বহু বৈধ ভোটারের নাম বাদ পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
তাড়াহুড়োর প্রশ্ন: দলের শীর্ষ নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে কেন এই দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া শুরু করা হলো, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।
মামলা: নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলি সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেছে।
বিজেপির পাল্টা: "তালিকায় শুদ্ধিকরণ চাই, বিরোধীদের ভয় কেন?"
অন্যদিকে, বিজেপি এই বিশেষ সংশোধনী প্রক্রিয়াকে সমর্থন জানিয়েছে। তাদের দাবি, দীর্ঘকাল ধরে রাজ্যে ভোটার তালিকায় প্রচুর 'ভুতুড়ে ভোটার' (Ghost Voters) এবং 'অবৈধ অনুপ্রবেশকারী' (Illegal Foreigners) নাম রয়েছে। SIR-এর মাধ্যমে সেই তালিকা 'শুদ্ধিকরণ' (Purity of Rolls) করা সম্ভব হবে।
বিজেপির দাবি: তারা অভিযোগ করেছে যে, শাসকদলের মদতে রাজ্যের অনেক জায়গায় বুথ লেভেল অফিসারদের (BLO) কাজ করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে এবং ফর্ম বিতরণে অনিয়ম করা হচ্ছে, যাতে কারচুপি বজায় রাখা যায়।
নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা: বিজেপি জোর দিয়ে বলছে যে, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক সংস্থা, এবং তারা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের নজরদারি
SIR-এর যৌক্তিকতা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে শুনানি শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে নোটিশ দিয়েছে এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে জবাব চেয়েছে। আদালত বিরোধীদের জিজ্ঞাসা করেছে যে, সাংবিধানিক সংস্থা পরিচালিত এই সংশোধনী নিয়ে তারা এত শঙ্কিত কেন। আদালত এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, বিভিন্ন রাজ্যের পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে কমিশনের কাজ করা উচিত।
অন্যদিকে, কলকাতা হাইকোর্টও এই প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নজর রাখছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বেড়া দেওয়ার (Indo-Bangladesh Border Fencing) ইস্যুতে রাজ্য সরকারের কাছে হলফনামা চেয়েছে হাইকোর্ট, যা প্রায়শই ভোটার তালিকা থেকে 'বিদেশি'দের নাম বাদ দেওয়ার অভিযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত।
সাধারণ মানুষের উদ্বেগ ও আতঙ্ক
রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরে, এই প্রক্রিয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
নাম বাদ পড়ার ভয়: বহু ভোটার ফর্ম পূরণ নিয়ে বিভ্রান্ত এবং তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ার ভয়ে ভুগছেন, যা অনেক ক্ষেত্রে মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে।
ক্ষেত্র বিশেষে মর্মান্তিক ঘটনা: নাম বাদ পড়ার আশঙ্কায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটেছে বলে সংবাদসূত্রে খবর।
যদিও নির্বাচন কমিশন রাজ্য জুড়ে দ্রুত ফর্ম বিতরণের কাজ চালাচ্ছে এবং সমস্ত ভোটারকে তাদের নাম যাচাই করার সুযোগ দিতে চাইছে, তবুও নির্বাচনমুখী বাংলায় এই SIR বিতর্ক বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত ও সংবেদনশীল বিষয় হয়ে উঠেছে।