সূর্যের কাছে গিয়ে রং বদল! আন্তনাক্ষত্রিক ধূমকেতু 3I/ATLAS নীল হওয়ায় বিস্মিত বিজ্ঞানীরা
নিজস্ব প্রতিবেদক | বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
আমাদের সৌরজগতের মধ্য দিয়ে ভ্রমণের সময় আরও রহস্যময় হয়ে উঠল আন্তনাক্ষত্রিক ধূমকেতু 3I/ATLAS। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ফেরার সময় এর রং বদলে গেছে বলে নতুন উপাত্তে জানা গেছে। সাধারণত ধূমকেতু সূর্যের কাছে গেলে এর চারপাশের ধূলিকণার কারণে লালচে বর্ণ ধারণ করে, কিন্তু 3I/ATLAS নীল রঙ ধারণ করেছে, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের হতবাক করেছে। এই অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন ফের উসকে দিয়েছে এই মহাজাগতিক বস্তুটি আসলে একটি 'এলিয়েন মহাকাশযান' কিনা, সেই বিতর্ক।
অপ্রত্যাশিত 'নীল দৈত্য'
সম্প্রতি প্রকাশিত নতুন তথ্যে জানা গেছে, 3I/ATLAS যখন সূর্যের নিকটতম বিন্দু, অর্থাৎ সূর্যনিকটের (Perihelion) কাছে পৌঁছায়, তখন এটি অপ্রত্যাশিতভাবে নীল রঙ ধারণ করে। একটি ধূমকেতুর ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত অস্বাভাবিক ঘটনা। হার্ভার্ডের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক আভি লোয়েব (Avi Loeb) এই রং পরিবর্তনকে ধূমকেতুটির নবম ব্যতিক্রম (Ninth Anomaly) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, প্রাকৃতিকভাবে একটি ধূমকেতুর পৃষ্ঠভাগ সূর্যের ফটোস্ফিয়ারের (৫,৮০০ কেলভিন) চেয়ে অনেক বেশি ঠান্ডা থাকে। এই ঠান্ডার কারণে এবং এর চারপাশের ধূলিকণা সূর্যালোককে প্রতিফলিত করার সময় আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে 'লাল' দিকে সরিয়ে দেয়, ফলে ধূমকেতুর রং লালচে দেখানোর কথা। কিন্তু 3I/ATLAS এর ক্ষেত্রে এই সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা ঘটেছে— এটি নীল হয়ে গেছে।
লোয়েব মনে করেন, এই রহস্যময় নীল রঙের ব্যাখ্যায় তিনি একটি 'উত্তপ্ত ইঞ্জিন' বা 'কৃত্রিম আলোর উৎস'-এর মতো বিষয়কে দায়ী করতে পারেন, যা এই জল্পনাকে আরও জোরদার করেছে যে 3I/ATLAS কোনও প্রাকৃতিক বস্তু নয়, বরং কোনও উন্নত সভ্যতার প্রযুক্তিগত কাঠামোর অংশ।
গতিপথেও অস্বাভাবিকতা
রং পরিবর্তনের পাশাপাশি, সূর্যকে অতিক্রম করার সময় 3I/ATLAS আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ অস্বাভাবিকতা দেখিয়েছে।
১. অস্বাভাবিক ত্বরণ: নাসা-র তথ্য অনুযায়ী, ধূমকেতুটি প্রথমবার মহাকর্ষীয় নয় এমন ত্বরণ (Non-gravitational acceleration) দেখিয়েছে। এর অর্থ হলো, শুধুমাত্র সূর্যের মহাকর্ষীয় টানের ফলে এর গতিপথে যে পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল, তা ঘটেনি। এই অপ্রত্যাশিত গতিপথের পরিবর্তন অনেকে কোনও অভ্যন্তরীণ ইঞ্জিনের শক্তি ব্যবহারের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।
২. আচমকা ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি: সূর্যনিকটের ঠিক আগে ধূমকেতুটি দ্রুত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এর ঔজ্জ্বল্য এতটাই বেড়ে যায় যে এটিকে তারার সঙ্গেও তুলনা করা হচ্ছে। ধূমকেতুর এই অস্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি এবং গতিপথের পরিবর্তন— এই সমস্ত কিছুই এটিকে মহাবিশ্বের এক অন্যতম রহস্যময় বস্তুতে পরিণত করেছে।
প্রাণের সন্ধানে প্রাচীন ধূমকেতু
ধারণা করা হয়, এই আন্তনাক্ষত্রিক ধূমকেতুটির বয়স ৭ থেকে ১৪ বিলিয়ন বছর, যা আমাদের নিজস্ব সৌরজগতের (৪.৬ বিলিয়ন বছর) থেকেও প্রাচীন। এটির আদিম অবস্থা ভিন্ন নক্ষত্রমণ্ডলের গঠন এবং ইতিহাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে।
এর আগে বিজ্ঞানীরা এই ধূমকেতু থেকে জলীয় বাষ্পের (Hydroxyl gas) রাসায়নিক স্বাক্ষর দেখতে পেয়েছিলেন। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এই জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি অন্যান্য নক্ষত্রমণ্ডলে প্রাণের অস্তিত্ব বা জীবনধারণের উপযোগী পরিবেশ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র দিতে পারে।
বিজ্ঞানীরা এখন কিসের অপেক্ষায়?
বর্তমানে, 3I/ATLAS সূর্যের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং বিজ্ঞানীরা এর নতুন তথ্য বিশ্লেষণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। সূর্যালোকের প্রভাবে (Sublimation-এর কারণে) ধূমকেতুটি কতটা ভর হারিয়েছে এবং এর চূড়ান্ত গতিপথে কী পরিবর্তন এসেছে— সেই বিস্তারিত তথ্য আগামী দিনগুলিতে জানা যাবে। এই 'নীল দৈত্য'-এর সত্যতা জানতে আরও নতুন তথ্যের অপেক্ষায় বিশ্বজুড়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান মহল।
© লোকসংবাদ (LokSangBad)। সমস্ত স্বত্ব সংরক্ষিত।
আরও পড়ুন: