PCOS বা PCOD: কেন মেট্রো শহরগুলিতে বাড়ছে এই সমস্যা? জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাসে কীভাবে মোকাবিলা করবেন?
স্বাস্থ্য ডেস্ক, লোকসংবাদ
কলকাতা: ১৬ নভেম্বর, ২০২৫
একবিংশ শতকে মহিলাদের মধ্যে যে কয়েকটি স্বাস্থ্য সমস্যা দ্রুত হারে বাড়ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো PCOS (Polycystic Ovary Syndrome) বা PCOD (Polycystic Ovary Disease)। একসময় এটিকে একটি বিরল সমস্যা বলে মনে করা হলেও, বর্তমানে মেট্রো শহরগুলিতে প্রতি ৫ জন মহিলার মধ্যে প্রায় ১ জন এই সমস্যায় ভুগছেন। দ্রুত পরিবর্তনশীল জীবনধারা, খাদ্যাভ্যাস এবং মানসিক চাপই এই সমস্যার প্রধান কারণ।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের (Gestational Diabetes) মতোই PCOS/PCOD কেবল একটি সমস্যা নয়, এটি ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় সতর্কতা। লোকসংবাদ নিউজের এই বিশেষ প্রতিবেদনে, আমরা এই সমস্যা বাড়ার কারণ ও তা মোকাবিলার সহজ উপায়গুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
PCOS/PCOD কী? কেন এত সাধারণ এই রোগ?
PCOS বা PCOD হল মহিলাদের হরমোনজনিত একটি সমস্যা। এই অবস্থায় ওভারিতে (Ovary) সিস্ট (ছোট ছোট তরল ভর্তি থলি) তৈরি হয় এবং পুরুষ হরমোন (Androgen) নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যায়। এই রোগে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নির্গত হতে পারে না, ফলে এটি সরাসরি সন্তান ধারণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। এটি একটি সাধারণ এন্ডোক্রাইন ডিসঅর্ডার যা মহিলাদের মধ্যে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টি করে।
PCOS বাড়ার মূল কারণ (বিশেষত মেট্রো শহরগুলিতে):
১. অতিরিক্ত মানসিক চাপ (Stress): কর্পোরেট জীবন, পড়াশোোনা এবং ব্যক্তিগত জীবনের চাপ কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কর্টিসলের মাত্রা বাড়লে শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স (Insulin Resistance) দেখা দেয়। এই ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সই হলো PCOS-এর প্রধান কারণ।
২. স্থূলতা এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস (Obesity & Diet): বর্তমানে ফাস্ট ফুড, চিনিযুক্ত পানীয় এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার (Processed Foods) বেশি খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এই ধরনের খাবার শরীরে দ্রুত ফ্যাট জমা করে ওজন বাড়ায় এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা কমিয়ে দেয়, যা PCOS-কে আরও বাড়িয়ে তোলে।
৩. কম শারীরিক সক্রিয়তা (Sedentary Lifestyle): দীর্ঘক্ষণ ডেস্কে বসে কাজ করা বা ওয়ার্ক ফ্রম হোমের কারণে শারীরিক পরিশ্রম প্রায় শূন্যে নেমে আসে। এর ফলে শরীর তার স্বাভাবিক হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না।
৪. জেনেটিক কারণ ও পরিবেশ: যদিও জীবনধারা একটি বড় কারণ, তবে জেনেটিক প্রবণতাও কাজ করে। পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ এবং ঘুম-জাগরণের চক্রে অনিয়ম (Sleep Deprivation) হরমোন নিঃসরণে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে।
PCOS/PCOD রোগের প্রধান লক্ষণগুলি কী কী?
সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করার জন্য এই লক্ষণগুলি সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি:
অনিয়মিত পিরিয়ড (Irregular Periods): পিরিয়ড দেরি হওয়া, বেশি রক্তপাত হওয়া বা তিন মাস বা তার বেশি সময় ধরে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
অতিরিক্ত অবাঞ্ছিত লোম (Hirsutism): পুরুষ হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ঠোঁটের উপরে, চিবুকে, বুকে বা পেটে পুরুষের মতো ঘন ও কালো লোম গজানো।
ওজন বৃদ্ধি (Weight Gain): বিশেষত কোমরের চারপাশে অস্বাভাবিক হারে ফ্যাট জমা হওয়া।
ত্বকের সমস্যা: মুখে ও পিঠে গুরুতর ব্রণ এবং অ্যাকান্থোসিস নিগ্রিক্যানস (ঘাড় ও বগলে ত্বক কালো হয়ে যাওয়া) দেখা দেওয়া।
চুল পাতলা হওয়া (Hair Thinning): মাথার চুল অস্বাভাবিক হারে ঝরে যাওয়া বা টাক পড়ে যাওয়া।
জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাসে আনুন এই পরিবর্তন
ওষুধের পাশাপাশি জীবনধারা পরিবর্তনই হলো PCOS মোকাবিলার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। সঠিক জীবনযাত্রার মাধ্যমে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমানো সম্ভব, যা রোগের মূল কারণ।
১. খাদ্যাভ্যাসই আসল ওষুধ (Dietary Changes):
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন যে খাদ্যতালিকায় এমন খাবার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যা ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বাড়ায়।
কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত খাবার: সাদা ভাত বা ময়দার বদলে ব্রাউন রাইস, ওটস, জোয়ার, বাজরা বা ডালিয়া খান। এই শস্যগুলি রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়ায় না।
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং প্রোটিন: খাদ্যতালিকায় মাছ, ডিম, চর্বিহীন চিকেন এবং প্রচুর পরিমাণে ডাল রাখুন। পাশাপাশি কাঠবাদাম, আখরোট, চিয়া সিড বা ফ্ল্যাক্স সিড (Flax Seed)-এর মতো ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড যুক্ত খাবার খাওয়া আবশ্যক।
বর্জনীয়: প্রক্রিয়াজাত চিনি (যেমন সফ্ট ড্রিংকস, প্যাকেটজাত জুস) এবং অতিরিক্ত তেল-মসলাযুক্ত খাবার সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলুন।
২. জীবনধারা পরিবর্তন (Lifestyle Modifications):
নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট মাঝারি ধরনের কার্ডিও বা যোগাভ্যাস করা উচিত। সপ্তাহে পাঁচ দিন দ্রুত হাঁটা বা সাইক্লিং করলে ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বাড়ে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ: একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে শরীরের মোট ওজনের ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। এই সামান্য পরিবর্তনও হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে।
মানসিক চাপ কমানো: দৈনিক ১০-১৫ মিনিটের জন্য ধ্যান (Meditation), মাইন্ডফুলনেস (Mindfulness) বা গভীর শ্বাসের ব্যায়াম করুন। যোগা বা হালকা মিউজিক শোনা কর্টিসলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে খুব কার্যকরী।
পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমোতে যান এবং ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন ঘুম নিশ্চিত করুন। ঘুমের অভাব PCOS-এর লক্ষণগুলিকে আরও গুরুতর করে তুলতে পারে।
PCOS বা PCOD একটি দীর্ঘমেয়াদী জীবনযাত্রাজনিত সমস্যা। তবে সঠিক সময়ে সচেতন হয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাসে ইতিবাচক পরিবর্তন আনলে এই সমস্যাকে শুধু নিয়ন্ত্রণে রাখাই নয়, বরং সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করাও সম্ভব।
Disclaimer: এই প্রতিবেদনটি শুধুমাত্র সাধারণ তথ্যের জন্য। যেকোনো চিকিৎসার জন্য অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।