লোকসংবাদ প্রতিবেদন: অক্টোবর ২৯, ২০২৫ সূত্র: কলকাতা
পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে দুই প্রধান ইস্যুতে রাজ্য রাজনীতি উত্তাল— প্রথমত, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির দ্বারা একের পর এক বৃহত্তর দুর্নীতির তদন্ত; এবং দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনের 'স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন' (SIR) বা ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন কর্মসূচি, যার মূল লক্ষ্য 'বেআইনি বিদেশী অভিবাসী' (Illegal Migrants) বা "বাংলাদেশী" ভোটারদের চিহ্নিত করা। এই জোড়া সঙ্কট আসন্ন ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাংলার রাজনৈতিক জলকে এক ভিন্ন দিকে চালিত করছে।
ভোটার তালিকার SIR: 'বাংলাদেশী' ইস্যু ও রাজনৈতিক বিতর্ক
ভারতের নির্বাচন কমিশন (ECI) পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের SIR (Special Intensive Revision) প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো ভোটার তালিকা থেকে মৃত, স্থানান্তরিত, নকল এবং বিশেষত 'বেআইনি বিদেশী অভিবাসী' ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া।
| SIR-এর মূল লক্ষ্য ও সময়সূচী | তথ্যসূত্র ও রাজনৈতিক অবস্থান |
| মূল লক্ষ্য: প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার জানিয়েছেন, SIR-এর প্রধান লক্ষ্য হলো অবৈধ বিদেশী অভিবাসীদের চিহ্নিত করে তাদের নাম বাদ দেওয়া। এই প্রক্রিয়াটি ২০০২-২০০৪ সালের তালিকাটিকে ভিত্তি ধরে এগোবে। | বিজেপি-র দাবি: বিজেপি-র রাজ্য নেতৃত্ব প্রকাশ্যে দাবি করেছে যে, রাজ্যের ভোটার তালিকায় বিপুল সংখ্যক 'বাংলাদেশী মুসলিম'-এর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাদের বক্তব্য, এই প্রক্রিয়ায় সেই সমস্ত নাম বাদ পড়বে এবং শাসকদলের 'বাংলাদেশী ভোটব্যাঙ্ক' দুর্বল হবে। |
| সময়সূচী: Enumeration বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য যাচাইয়ের কাজ শুরু হবে ৪ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫। চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশিত হবে ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৬। | তৃণমূলের প্রতিবাদ: শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এই প্রক্রিয়াকে "CAA-NRC কার্যকর করার পূর্ব-প্রস্তুতি" বলে বর্ণনা করেছে। তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, যদি কোনও বৈধ ভোটারের নাম বাদ যায় বা ভোটারদের হয়রানি করা হয়, তবে তারা গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ করবে। মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম দাবি করেছেন, দল কোনও 'জেনুইন ভোটারের' নাম বাদ যেতে দেবে না। |
| সিইও-র আশ্বাস: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (CEO) মনোজ আগরওয়াল সর্বদলীয় সভার পর আশ্বাস দিয়েছেন যে, SIR প্রক্রিয়াটি নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল। তিনি নিশ্চিত করেছেন, "কোনও বৈধ ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে না।" | সাধারণ মানুষের উদ্বেগ: বিহারে SIR-এর পর প্রায় ৪২ লাখ ভোটারের নাম বাদ পড়ায়, পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের মধ্যে, বিশেষত প্রান্তিক ও দুর্বল অংশের মানুষের মধ্যে, নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি দাখিল নিয়ে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। |
দুর্নীতির তদন্ত: ভোট-রাজনীতিতে জলের স্রোত
যখন ভোটার তালিকা সংশোধনের কারণে নাগরিকত্বের প্রশ্ন নিয়ে বাংলার রাজনীতি উত্তপ্ত, ঠিক তখনই কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির দুর্নীতি তদন্ত রাজ্যের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
| দুর্নীতির ঘটনা | রাজনৈতিক প্রবাহে প্রভাব |
| নিয়োগ দুর্নীতি (SSC/পুরসভা): অয়ন শীলের মতো প্রোমোটারদের গ্রেফতারি এবং মন্ত্রী-নেতাদের বাড়িতে তল্লাশি এই ইঙ্গিত দিয়েছে যে, একটি সমান্তরাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল যেখানে চাকরি কার্যত বিক্রি হয়েছে। | এই ঘটনা শিক্ষিত যুবসমাজ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে শাসকদলের বিরুদ্ধে যে নৈরাজ্যের ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, তা ২০২৬-এর ভোটে বড় ফ্যাক্টর হবে। |
| রেশন দুর্নীতি: প্রাক্তন মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের জামিন বাতিলের জন্য ইডি-র তৎপরতা গ্রামীণ স্তরের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। | এই ঘটনা তৃণমূলের 'গরিব-দরদি' ভাবমূর্তিকে আঘাত করছে এবং বিরোধীদের হাতে দুর্নীতিমুক্ত সরকার গঠনের একটি বড় ইস্যু তুলে দিয়েছে। |
| বিরোধী শিবিরে কোন্দল: কল্যাণীর AIIMS-এ নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে বিজেপি-র দুই বিধায়কের মধ্যে প্রকাশ্যে বাকযুদ্ধ বিরোধী শিবিরের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। | তৃণমূল এই ঘটনাকে "বিজেপি-র অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও বিভাজন" বলে কটাক্ষ করে নিজেদের উপর থেকে কিছুটা চাপ সরানোর চেষ্টা করছে। |
২০২৬-এর ভোটচিত্র: দুর্নীতি ও SIR-এর প্রভাব
বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই দুটি ইস্যু একে অপরের পরিপূরক হয়ে প্রভাব ফেলবে:
ভোটব্যাঙ্ক বনাম নাগরিকত্ব: বিজেপি SIR-কে ব্যবহার করে 'অবৈধ বাংলাদেশী ভোটারদের' নাম বাদ দেওয়ার মাধ্যমে তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কে আঘাত হানতে চাইছে। অন্যদিকে, তৃণমূল এই প্রক্রিয়াকে 'নাগরিকের অধিকার হরণ' বলে প্রতিবাদ করে তাদের সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক ভোটব্যাঙ্ককে সংহত রাখতে চাইছে।
জনগণের চূড়ান্ত বিচার: যেখানে দুর্নীতি রাজ্যের অর্থনৈতিক জীবন-জীবিকা ধ্বংস করেছে, সেখানে SIR নাগরিকের অস্তিত্বের উপর প্রশ্ন তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে, জনগণ কাকে বিশ্বাস করবে? যে দল দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও নাগরিকত্বের সুরক্ষার কথা বলছে, নাকি যে দল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে কিন্তু একই সাথে 'নাগরিকত্ব' নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে?
এখন আদালতের নজরদারিতে যেমন দুর্নীতি তদন্ত চলছে, তেমনি নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতাও SIR প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা হবে। এই জোড়া সঙ্কটের ফলে ২০২৬-এর নির্বাচন রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হতে চলেছে, যেখানে দুর্নীতি এবং নাগরিকত্ব – এই দুই ইস্যুই ভোট নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা নেবে।
